শব্দ দূষণ কী – শব্দ দূষণ বলতে বুঝায় মানুষের কার্যকলাপের ফলে কোন বস্তু থেকে উৎপন্ন অতিরিক্ত শব্দ, যা মানুষের মানুষের স্বাস্থ্য, সুস্থতা এবং পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মানুষ সাধারণত ২০ হার্জের কম এবং ২০,০০০ বেশি শব্দ শুনতে পায় না।
শব্দ দূষণ হল এমন এক ধরনের দূষণ, যেখানে মানুষের কার্যকলাপের ফলে শব্দের মাত্রা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি হয়ে যায়। এই অতিরিক্ত শব্দ মানুষের স্বাস্থ্য, সুস্থতা এবং পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
শব্দ দূষণের উৎসগুলির মধ্যে রয়েছে যানবাহন, শিল্প, নির্মাণ, বিনোদন এবং এমনকি মানুষের কথাবার্তা। আমরা আলোচনা করতে চলেছি, শব্দ দূষণ কী, যা ইতিমধ্যে জেনেছো, শব্দ দূষণের প্রভাব কী, শব্দ দূষণের ১০টি কারণ, শব্দ দূষণের প্রতিকার ১০টি, এবং শব্দ দূষণকারীর শাস্তি।
শব্দ দূষণের প্রভাব কী
শব্দ দূষণের প্রভাবগুলি মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। দিন যত যাচ্ছে শব্দ দূষণের মাত্রা তত বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে মানুষের স্বাস্থ্যের, এবং পরিবেশের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। শব্দ দূষণের জন্য মানুষ দায়ী এবং শব্দ দূষণ মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে।
মানুষের স্বাস্থ্যের প্রভাব
শব্দ দূষণের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাবগুলি মানুষের স্বাস্থ্যের উপর। শব্দ দূষণের কারণে শ্রবণ ক্ষতি, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক চাপ, ঘুমের ব্যাঘাত এবং শিশুদের বিকাশে সমস্যা হতে পারে।
(ক) শ্রবণ ক্ষতি: শব্দ দূষণের কারণে শ্রবণ ক্ষতি সবচেয়ে সাধারণ প্রভাব। দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ শব্দের সংস্পর্শে থাকলে কানের ভেতরে থাকা ঝিল্লি এবং নার্ভগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যার ফলে শ্রবণ ক্ষতি হয়।
(খ) হৃদরোগ: শব্দ দূষণের কারণে হৃদযন্ত্রের হার এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে পারে। এটি হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
(গ) উচ্চ রক্তচাপ: শব্দ দূষণের কারণে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
(ঘ) মানসিক চাপ: শব্দ দূষণের কারণে মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতার ঝুঁকি বাড়তে পারে।
(ঙ) ঘুমের ব্যাঘাত: শব্দ দূষণের কারণে ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে, যা ক্লান্তি, মনোযোগের অভাব এবং মেজাজের পরিবর্তনের দিকে পরিচালিত করতে পারে।
(চ) শিশুদের বিকাশে সমস্যা: শব্দ দূষণের কারণে শিশুদের ভাষা বিকাশ, শিক্ষা এবং আচরণে সমস্যা হতে পারে।
পরিবেশের প্রভাব
শব্দ দূষণের কারণে পরিবেশের উপরও প্রভাব
শব্দ দূষণের কারণে পরিবেশের উপরও প্রভাব পড়তে পারে। শব্দ দূষণের কারণে প্রাণীজগতের আচরণে পরিবর্তন হতে পারে, উদ্ভিদের বৃদ্ধির প্রতিবন্ধকতা হতে পারে এবং জীববৈচিত্র্য হ্রাস পেতে পারে।
প্রাণীজগতের আচরণে পরিবর্তন: শব্দ দূষণের কারণে প্রাণীজগতের আচরণে পরিবর্তন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, শব্দ দূষণের কারণে পাখিরা তাদের বাসা তৈরি করতে বা খাবার খুঁজে পেতে অসুবিধা করতে পারে।
উদ্ভিদের বৃদ্ধির প্রতিবন্ধকতা: শব্দ দূষণের কারণে উদ্ভিদের বৃদ্ধির প্রতিবন্ধকতা হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, শব্দ দূষণের কারণে গাছপালা তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার হারাতে পারে।
জীববৈচিত্র্য হ্রাস: শব্দ দূষণের কারণে জীববৈচিত্র্য হ্রাস পেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, শব্দ দূষণের কারণে কিছু প্রাণী তাদের আবাসস্থল ছেড়ে যেতে পারে বা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
অর্থনীতির প্রভাব
শব্দ দূষণের কারণে অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়তে পারে। শব্দ দূষণের কারণে কর্মীদের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেতে পারে, ব্যবসায়ের ক্ষতি হতে পারে এবং সম্পত্তির মূল্য হ্রাস পেতে পারে।
শব্দ দূষণের ঝুঁকি কমাতে পদক্ষেপ
শব্দ দূষণের ঝুঁকি কমাতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি নেওয়া যেতে পারে:
- যানবাহন এবং শিল্পের শব্দ দূষণ কমাতে সরকারী নীতিগুলি বাস্তবায়ন করা।
- নির্মাণ এবং বিনোদনমূলক ইভেন্টগুলির সময় শব্দের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা।
- ব্যক্তিগতভাবে শব্দ দূষণের ঝুঁকি কমাতে পদক্ষেপ নেওয়া, যেমন হেডফোন ব্যবহার করে যানবাহন চালানোর সময় শব্দের মাত্রা কমানো।
শব্দ দূষণ একটি গুরুতর সমস্যা যা মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। শব্দ দূষণের ঝুঁকি কমাতে পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
শব্দ দূষণের ১০টি কারণ
শব্দ দূষণের ১০টি প্রধান কারণ হল:
- যানবাহন: যানবাহন শব্দ দূষণের সবচেয়ে সাধারণ উৎস। গাড়ির হর্ন, ইঞ্জিন, এবং ব্রেকিং শব্দগুলি শহরগুলিতে শব্দ দূষণের প্রধান কারণ।
- শিল্প: শিল্প কারখানাগুলি শব্দ দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস। উৎপাদন প্রক্রিয়া, যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জামগুলির শব্দগুলি শব্দ দূষণের কারণ হতে পারে।
- নির্মাণ: নির্মাণ কাজ শব্দ দূষণের আরেকটি প্রধান উৎস। ড্রিলিং, হমারিং এবং অন্যান্য সরঞ্জামের শব্দগুলি শব্দ দূষণের কারণ হতে পারে।
- বিনোদন: বিনোদনমূলক কার্যকলাপগুলি শব্দ দূষণের কারণ হতে পারে। কনসার্ট, খেলাধুলা এবং অন্যান্য ইভেন্টগুলির শব্দগুলি শব্দ দূষণের কারণ হতে পারে।
- জনসাধারণের স্থান: জনসাধারণের স্থানগুলি, যেমন স্কুল, হাসপাতাল এবং লাইব্রেরি, শব্দ দূষণের কারণ হতে পারে। লোকজনের কথা বলা এবং শব্দ করার শব্দগুলি শব্দ দূষণের কারণ হতে পারে।
- প্রাকৃতিক উৎস: প্রাকৃতিক উৎসগুলি, যেমন বজ্রপাত এবং সমুদ্রের ঢেউ, শব্দ দূষণের কারণ হতে পারে।
- ব্যক্তিগত কার্যকলাপ: ব্যক্তিগত কার্যকলাপ, যেমন গান শোনা এবং পোষা প্রাণীদের চিৎকার, শব্দ দূষণের কারণ হতে পারে।
- প্রযুক্তি: প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, যেমন উচ্চ শব্দের স্পিকার এবং ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলি, শব্দ দূষণের কারণ হতে পারে।
- নগর পরিকল্পনা: ভুল নগর পরিকল্পনা শব্দ দূষণকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
- অবৈধ কার্যকলাপ: অবৈধ কার্যকলাপ, যেমন রাস্তায় হর্ন বাজানো, শব্দ দূষণের কারণ হতে পারে।
এই কারণগুলির মধ্যে, যানবাহন, শিল্প এবং নির্মাণ শব্দ দূষণের সবচেয়ে সাধারণ উৎস।
শব্দ দূষণের প্রতিকার
শব্দ দূষণের প্রতিকার নিয়ে ১০টি উপায় দেয়া হয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়ন করে শব্দ দূষণের প্রতিকারশব্দ দূষণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে, যদি আমরা মেনে চলি এবং বাস্তবায়ন করি।
শব্দ দূষণ প্রতিরোধের ১০টি উপায়
-
যানবাহন শব্দ দূষণ কমাতে:
- যানবাহনের ইঞ্জিন এবং ব্রেকিং সিস্টেমগুলি আরও দক্ষ করে তোলা।
- যানবাহনের শব্দের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা।
- যানবাহনের সংখ্যা কমানো।
- যানবাহন ব্যবহারের বিকল্পগুলি প্রচার করা, যেমন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, সাইকেল এবং হাঁটা।
-
শিল্প শব্দ দূষণ কমাতে:
- শিল্প কারখানাগুলিতে শব্দ কমাতে প্রযুক্তি ব্যবহার করা।
- শিল্প কারখানাগুলিকে জনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে দূরে রাখা।
-
নির্মাণ শব্দ দূষণ কমাতে:
- নির্মাণ কাজের সময় শব্দের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা।
- নির্মাণ কাজের জন্য কম শব্দ তৈরি করে এমন সরঞ্জাম ব্যবহার করা।
-
বিনোদনমূলক শব্দ দূষণ কমাতে:
- বিনোদনমূলক ইভেন্টগুলির জন্য শব্দের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা।
- বিনোদনমূলক ইভেন্টগুলিকে জনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে দূরে রাখা।
-
ব্যক্তিগত শব্দ দূষণ কমাতে:
- গান শোনা বা অন্যান্য শব্দ উৎসগুলির ভলিউম কমানো।
- যানবাহন চালানোর সময় হেডফোন ব্যবহার করা।
- উচ্চ শব্দের সরঞ্জামগুলি ব্যবহার করার সময় সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম ব্যবহার করা।
-
নগর পরিকল্পনায় শব্দ দূষণ বিবেচনা করা:
- যানবাহন এবং শিল্প কারখানাগুলিকে জনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে দূরে রাখা।
- গাছপালা এবং অন্যান্য শব্দ-শোষণকারী উপাদানগুলি ব্যবহার করে শব্দ দূষণ কমানো।
-
আইন প্রয়োগ করা:
- শব্দ দূষণের জন্য আইন প্রয়োগ করা।
-
শিক্ষা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা:
- লোকেদের শব্দ দূষণের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করা।
- শব্দ দূষণ কমাতে লোকেদের পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করা।
এই পদক্ষেপগুলি শব্দ দূষণের ঝুঁকি কমাতে এবং মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশকে রক্ষা করতে সাহায্য করতে পারে।
শব্দ দূষণকারীর শাস্তি
বাংলাদেশে, শব্দ দূষণকারীদের শাস্তি নিম্নরূপ:
শব্দ দূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১০ অনুসারে, যে ব্যক্তি শব্দ দূষণের জন্য দায়ী হবে, তাকে প্রথমবার শাস্তি হিসেবে এক মাসের কারাদণ্ড বা এক হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
দ্বিতীয়বার শাস্তি হিসেবে দুই মাসের কারাদণ্ড বা দুই হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। তৃতীয়বার বা ততোধিকবার শাস্তি হিসেবে তিন মাসের কারাদণ্ড বা তিন হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুসারে, যে ব্যক্তি শব্দ দূষণের জন্য দায়ী হবে, তাকে প্রথমবার শাস্তি হিসেবে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
দ্বিতীয়বার শাস্তি হিসেবে এক বছরের কারাদণ্ড বা দশ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। তৃতীয়বার বা ততোধিকবার শাস্তি হিসেবে দুই বছরের কারাদণ্ড বা পনের হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
এছাড়াও, শব্দ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১৮৮ হ ধারা অনুসারে সরকারি কর্মচারীকে বাধা দেওয়া বা সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করার অভিযোগে মামলা করা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে, দোষী সাব্যস্ত হলে শাস্তি হিসেবে দুই বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
শব্দ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে, একজন ব্যক্তিকে প্রথমে স্থানীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে একটি অভিযোগ জমা দিতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযোগটি তদন্ত করবে এবং যদি তারা প্রমাণ পায় যে শব্দ দূষণ ঘটছে, তাহলে তারা দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবে।
শব্দ দূষণের ঝুঁকি কমাতে, প্রতিটি ব্যক্তিকে সচেতন হওয়া এবং শব্দ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।