দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান রচনা

রচনা

দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান

ভূমিকা: আধুনিক সভ্যতায় বিজ্ঞান এক অপরিহার্য বিষয়। ব্যবহারিক ও দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়া আমরা এক পা-ও চলতে পারি না। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বিজ্ঞান আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। তাকে ছাড়া আমাদের জীবন অচল–অনড়–জড়। জীবনকে ভরপুর করে দিয়েছে বিজ্ঞান।

বিজ্ঞান ও আধুনিক জীবন সমার্থক। আধুনিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অনিবার্য উপস্থিতি। এদিক থেকে বিজ্ঞান মানুষের প্রতিদিনের সঙ্গী ও বন্ধু।

সর্বত্র বিজ্ঞানের দান:  ঘরের আসবাবপত্র, বাক্স-বিছানা, নিত্য ব্যবহার্য বস্তুসামগ্রী, রান্নাবান্না, আহারবিহার, শিক্ষাদীক্ষা, রোগের চিকিৎসা, নিত্য-বিনোদন, খেলাধুলা, বিশাল কর্মজগৎ, ভ্রমণবিলাস জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বিজ্ঞানের অবদান ছাড়া আমরা আজ অচল।

আমাদের ব্যন্তিজীবনে, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় জীবনে— কোথায় নেই বিজ্ঞানের ছোঁয়া! সর্বত্র বিজ্ঞানের দান ছড়িয়ে রয়েছে। আমরা বিজ্ঞানের এই আশীর্বাদকে ব্যবহার করে জীবনকে সুখস্বাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে তুলছি। যে ঘরে বাস করছি— তার নির্মাণ হয়েছে বিজ্ঞানের দাক্ষিণ্যে।

রোগ নিরাময়ে বিজ্ঞান: বিশেষ করে শল্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ব্যবহৃত হচ্ছে আশ্চর্য দক্ষতায়। বিজ্ঞান মানুষের আয় অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিজ্ঞান এখন রোগ নিরাময়ে বিরাট ভূমিকা পালন করে। রোগের দুর্বিষহ যন্ত্রণা থেকে এমনকি মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করছে বিজ্ঞানের কল্যাণকারী শাখা— চিকিৎসা বিজ্ঞান। হাজারো রকমের ঔষধপত্র আবিষ্কার করেছে বিজ্ঞান।

শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞান:  পাঠ/পুস্তক, খাতা, কাগজ, কলম আর বিভিন্ন বিদ্যার অসংখ্য শিক্ষোপকরণ। আজকাল শিক্ষাব্যবস্থায় স্থান করে নিয়েছে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট ও বিজ্ঞানের তথ্য–প্রযুক্তির নানা বিস্ময়কর উপকরণ।

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ক্ষেত্র— শিক্ষাক্ষেত্র। শিক্ষাই সত্যতার বাহন। শিক্ষার দৌলতেই মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের অধিকারী। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ফলেই এসেছে মুদ্রাযন্ত্র আমরা পেয়েছি রাশি রাশি জ্ঞানমূলক গ্রন্থ।

কর্মক্ষেত্রে বিজ্ঞান: কলকারখানা, উৎপাদনকেন্দ্র, সবই তো বিজ্ঞানেরই সৃষ্টি। অফিস আদালতের টাইপরাইটার, ফাইলপত্র, কাগজ কলম। ঘরদোর— বিজ্ঞান না হলে তো রূপ পেত না! এমনকি, দৈনিক শ্রমিক যারা অর্থাৎ কামার, কুমোর, ছুতোর, জেলেদের মাছ ধরার আধুনিক হাতিয়ার বিজ্ঞানের কৃপায়ই তৈরি হয়েছে।

কর্ম মানুষের জীবনের নিত্যধর্ম। ছাত্রজীবনের পালা সাঙ্গ করে মানুষকে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হয়। অফিস, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, ফ্যাক্টরি, শিল্পসংস্থা প্রভৃতি কর্মক্ষেত্র আজ বিজ্ঞান তার নানা ডালি নিয়ে হাজির হয়েছে।

ভ্রমণ-যাতায়াতে বিজ্ঞান: ভ্রমণ ব্যবস্থায় বিজ্ঞান এনে দিয়েছে সুখস্বাচ্ছন্দ্য ও দুরন্ত গতি। বিজ্ঞানের দৌলতে আবিষ্কৃত হয়েছে বাইসাইকেল, স্কুটার, রিকশা, বিভিন্ন ধরনের মোটরযান, বাস-লরি, ট্রেন, জাহাজ, উড়োজাহাজ কত রকমারি যানবাহন। মানুষের: প্রতিদিনের যাতায়াতকে বিজ্ঞান করে দিয়েছে সুগম, করেছে সুখকর। সময়ের সাশ্রয় হচ্ছে। মানুষের শ্রমের লাঘব হচ্ছে।

বিনোদনে বিজ্ঞান:  যে হারমোনিয়াম, তবলা বাজিয়ে গান করা হয়, যে প্রকৌশলের ব্যবহারে রঙ্গমঞ্জে অভিনয় করা হয়, অর্থাৎ বাদ্যযন্ত্র, মেকআপ, আলোকসম্পাত, দৃশ্য নির্মাণ সবকিছুতেই বিজ্ঞানের সহায়তা প্রয়োজন।

আধুনিক যুগে বিজ্ঞানই এনে দিয়েছে বিনোদনের অফুরন্ত সম্ভার। বিজ্ঞান বিনোদনকে নব নব বৈচিত্রের মাধ্যমে পরম আকর্ষণীয় করে মানুষের সামনে তুলে ধরেছে।

সংযোগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান:  আজকাল চাই মুহুর্তে মুহূর্তে দূরে থাকা আত্মীয়স্বজন, ব্যাবসার অংশীদার, বন্ধুবান্ধব, নানা পেশায় নিযুক্ত মানুষের সঙ্গে অত্যাবশ্যকীয় সংযোগ। টেলিফোন, মোবাইল, ফ্যাক্স, ই-মেল, টেলিগ্রাফ, ওয়ারলেস, এস. টি. ডি. আই. এস. ডি.— বিজ্ঞান কত আশ্চর্য রকমের যন্ত্রপাতি, প্রকৌশল দিয়ে আমাদের সহায়তা করছে রাত্রিদিন। তা ছাড়া, ডাকব্যবস্থার মাধ্যমে চিঠি, পার্শেল, মানিঅর্ডার আদানপ্রদানও তো বিজ্ঞানেরই ফসল।

বিজ্ঞান সংযোগের ক্ষেত্রে নতুন যুগ এনে দিয়েছে। বিজ্ঞানের অসামান্য অবদানের অন্যতম হল প্রত্যহ লক্ষ লক্ষ কপি সংবাদপত্রের মুদ্রণ ও সরবরাহ। টেলিপ্রিন্টার, টেলেক্স ,অফসে্ট প্রিন্টার— বিজ্ঞান নিত্যনতুন আবিষ্কারে মুদ্রণ শিল্পে যুগান্তর এনেছে সৃষ্টি করছে।

গ্রামীণ জীবনে বিজ্ঞান: আজ কৃষকরা কলচালিত লাঙল, বীজবপন, আগাছাবাছাই, শস্যকর্তন, ঝাড়াই-মাড়াই, ধান ভাঙা সর্বক্ষেত্রেই কলের সাহায্য নিচ্ছেন। এসব চাষবাসের যন্ত্রপাতি সবই বিজ্ঞানের দৌলতে প্রাপ্ত।

আজ গ্রামীণ জীবনেও বিজ্ঞানের দান যথেষ্ট পরিমাণেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাদের দেশের গ্রামের অধিকাংশ মানুষই কৃষিজীবী। কৃষিক্ষেত্রে যেদিন লাঙ্গলের প্রবেশ ঘটেছিল, সেদিন থেকেই বিজ্ঞানের প্রবেশ ঘটেছিল গ্রামীণ জীবনে।

অন্যান্য ক্ষেত্রে বিজ্ঞান: মানুষের জীবনে বিজ্ঞানের অবদান বলে শেষ করার মত নয়। পূর্ব উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলি তার অতি সামান্য কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। ওই উদাহরণগুলি বাদ দিয়ে মানুষ আজও খাদ্য উৎপাদনের জন্য কৃষিক্ষেত্রে যেমন বিজ্ঞানের প্রয়োগ করে থাকে, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য শিল্প ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রয়োগ হয়ে থাকে।

অন্যদিকে শিক্ষাও আজ সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক হয়ে উঠেছে। তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার সম্ভব হয়েছে। অনেক জটিল প্রক্রিয়ার অত্যন্ত সহজ সমাধান মানুষ করে ফেলছে শুধুমাত্র বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে। বিজ্ঞান আজ দূরকে করেছে নিকট, সমগ্র বিশ্বকে বন্দী করেছে হাতের মুঠোয়। বিজ্ঞানের দানে আঙ্গুলের একটিমাত্র ছোঁয়ায় পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের তথ্যও এক নিমেষে ভেসে উঠছে মানুষের চোখের সামনে।

বিজ্ঞান বনাম মানুষ: ইলেকট্রনিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অন্যান্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মেলবন্ধনে রোবট ও কম্পিউটারের আবিষ্কার মানুষের জীবনধারার পটচিত্রকে আমুল বদলে দিয়েছে। ফলস্বরূপ প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ পরিণত হয়েছে যন্ত্রের আজ্ঞাবহ দাসানুদাসে। এক মুহুর্ত আধুনিক প্রযুক্তির প্রত্যক্ষ সহায়তা ছাড়া মানুষ আজ অত্যন্ত অসহায়, নিরুপায় বোধ করে।

তবে বিজ্ঞানের প্রভাবে মানুষ আজ যন্ত্রমানবে পরিণত হয়েছে, তাকে অনুসরণ করে যন্ত্র নিয়ন্ত্রিত হয় না বরং যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে বর্তমান সময়ের মানুষ চালিত হয়। জীবনকে সহজ ও সুখের করে তোলার জন্য মানুষের সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা তাকে নতুন নতুন আবিষ্কার করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। পনেরোই যন্ত্রভিত্তিক জীবন আজ যান্ত্রিক জীবনে পরিণত হয়েছে।

প্রযুক্তি বিজ্ঞান ও দারিদ্র: প্রযুক্তি বিজ্ঞান মানুষের জীবনকে সহজ ও সুখের করে তুলেছে এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে এমন সমূহ অগ্রগতি সত্ত্বেও বিজ্ঞান আজও পৃথিবী থেকে অভিশাপরূপি দারিদ্র্যকে নির্মূল করতে পারেনি। কিছু ক্ষেত্রে দারিদ্র্য থেকে উত্তরণে সহায়তা করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিজ্ঞান ধনী-দরিদ্র্যের আর্থিক বৈষম্যের ব্যবধানকে বহুমাত্রায় বাড়িয়ে তুলেছে।

তাছাড়া প্রযুক্তি বিজ্ঞানের নানান অভিনব আবিষ্কার উপভোগ করতে প্রয়োজন অর্থনৈতিক সচ্ছলতা। যেখানে আমাদের দেশের বহু মানুষ দারিদ্র সমস্যায় জর্জরিত সেখানে প্রযুক্তিগত এইসব অভিনব উপাদানের ব্যবহার, বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রযুক্তি বিজ্ঞানের নানান সুবিধা গুলো যেদিন গরীব মানুষদের কাছেও পৌঁছে যাবে সেদিনই আধুনিক বিজ্ঞানের দানে সভ্যতা সার্থক হয়ে উঠবে।

বিজ্ঞান: আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ: মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ থেকে সহজতর ওপারেতে বিজ্ঞান যেমন প্রতিনিয়ত অসীম অবদান রেখে চলেছে, তেমনি পৃথিবীতে শাশ্বত শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রধান বাধাও এই বিজ্ঞানই। বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই আধুনিক যুগে তৈরি হয়েছে মারাত্মক সব মারণাস্ত্র।

অন্যদিকে এই বিজ্ঞানই বহু দিক থেকে মানুষের জীবনের প্রাথমিক গঠনগত চরিত্রকে প্রভাবিত করে সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে সংকট সৃষ্টি করছে। তাই সে কথা মাথায় রেখে মানুষের কাছে আধুনিক বিজ্ঞান প্রকৃতপক্ষে আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ সে বিতর্ক থেকেই যায়।

বিজ্ঞানের অপকারিতা: পৃথিবীতে সকল জিনিসেরই খারাপ ভালো উভয় দিকই বর্তমান। যন্ত্রের উপর নির্ভর করতে গিয়ে আজ মানুষ দিনদিন শ্রমবিমুখ হয়ে পড়ছে, ক্রমশ কমে যাচ্ছে মানুষের স্বনির্ভরতা। ফলে শরীরে নানান রোগ এসে বাসা বাঁধছে।

বিজ্ঞান হল বর্তমান মানুষের হাতিয়ার। এই হাতিয়ারকে সৎ অসৎ যেকোনো কাজেই ব্যবহার করা সম্ভব। বিজ্ঞানের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে প্রয়োগ কর্তার উপর। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পরমাণু শক্তি যেমন ব্যাপক মানবকল্যাণে ব্যবহৃত হতে পারে, তেমনই এক মুহূর্তে ধ্বংস করে দিতে পারে সম্পূর্ণ পৃথিবীর জীবজগৎকে।

বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মুমূর্ষু রোগীর প্রাণ বাঁচানো যেমন সম্ভব, তেমনি সেই বিজ্ঞানেরই দানে কেবলমাত্র একটি বোতাম টিপে এক সম্পূর্ণ জনপদ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াও সম্ভব। মানুষের লোভ, হিংসা তথা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য দিনদিন বিজ্ঞান নানান খারাপ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

উপসংহার: শুধু তবু কেন মানুষ বিজ্ঞানের দাস হয়ে নিজের শন্তি ও কর্মঞ্চমতাকে বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতির কাছে বিকিয়ে দেবে? তবু কেন বিজ্ঞান প্রতিদিন সকালে মানুষের জীবনে একটা টকটকে লাল গোলাপ হয়ে ফুটে উঠবে না?

একুশ শতকে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন যে একান্তভাবেই বিজ্ঞাননির্ভর হয়ে দাড়িয়েছে এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

মন্তব্য করুন

You cannot copy content of this page